বুয়েটকাল [কিস্তি ৩]



শাকুর মজিদ

  • Font increase
  • Font Decrease

কিস্তি ২.  মেডিকেল হোস্টেলের প্যারাসাইট জীবন

বুয়েটপরশ

১৯৮৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। বুয়েটে আমাদের প্রথম ক্লাস। স্কুল-কলেজ জীবন একত্রে কাটিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু হওয়া নিয়ে উৎকণ্ঠার শেষ ছিল না আমাদের। ১৯৮৪ সালে যারা উচ্চ মাধ্যমিক অতিক্রম করেছি তারা সে বছর নভেম্বর মাসের ২৯-৩০ তারিখে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছি বুয়েটে। ফল প্রকাশে বুয়েট সবসময়ই ত্বরিৎ। ’৮৫র জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির মধ্যে ভর্তির যাবতীয় কলা কানুন শেষ করে তখন ছিল আমাদের ক্লাস শুরুর প্রতীক্ষা। কিন্তু সামনে আটকানো ছিল সেশন। সে সময়কার স্বৈরাচারী শাসক এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে করতে এবং আন্দোলন না করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় অতর্কিতে বন্ধ করতে করতে সময় চলে যায়। মেঘে মেঘে নয়, ঝড় ঝঞ্ঝায় বেলা বয়ে যেত অনেক। শুরু হতো সেশন জট। সেই জট পাক ধরতে শুরু করে দিনে দিনে। দিন যায়, পরীক্ষা আসে, পরীক্ষা যায়। কিন্তু চার ও পাঁচ বছরের কোর্স চার ও পাঁচ বছরে কখনোই শেষ হয় না! এমনই এক বিরুদ্ধ স্রোতের মধ্যেই শুরুর তারিখ হয়।

শুনেছিলাম, ঢাকার বাইরে থেকে যারা আসে সেসকল ছাত্রদের জন্য হলে সিট থাকবেই। মেয়েদের হল নাই। তারা তিতুমীর হলের সাথে এটাচড। বুয়েটের এদ্মিন বিল্ডিংয়ের কোনায় কয়েকটা রুম আছে সেখানে কয়েকজন ছাত্রী থাকে।

১৭ ফেব্রুয়ারি রাতেই চলে আসি তিতুমীর হলের প্রভোস্টের রুমে। যিনি এসিস্ট্যান্ট প্রভোস্ট তিনি ফরম ফিলাপ করিয়ে ৫৪০ টাকার ফি নিচ্ছেন। এটা বার্ষিক ফি। সারা বছরের জন্য আমার থাকার খরচ মাত্র ৫৫০ টাকা। খারাপ না। আমি ১০৬ (দক্ষিণ) এর একটা স্লিপ পাই।

আমি আমার জন্য বরাদ্দ পাওয়া রুমে চলে যাই। আমার হাতে রুম এলটমেন্টের কাগজ, কিন্তু পড়ি বিপাকে।  রুমে গিয়ে শুনি, আমার জন্য বরাদ্দ হওয়া সিটে যে বিদায়ী বড় ভাইয়ের বিছানা, তা খালি হতে সময় লাগবে আরো কিছুদিন। তিনি রেফার্ড পেয়েছিলেন, পরীক্ষাও দিয়ে দিয়েছেন। শুধু ফল প্রকাশ বাকি। এই ফল প্রকাশ হলে, তিনি পাশ করে গেলে, এখানে আমার সিট হবে। ফেল করে গেলে তিনিই থেকে যাবেন। থেকে যাবার সম্ভাবনা তার আছে। কারণ এর আগে আরো দু’বছর ধরে তিনি যাবেন যাবেন করে যাচ্ছেন না। ভাই আমার সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। বিয়ে করে ফেলেছেন তাঁর এক ছাত্রীকে। টিউশনি করাতে করাতে সম্পর্ক। সেখান থেকে বিয়ে। থাকেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শ্বশুরবাড়ি। কিন্তু শ্বশুর বাড়ির লোকেরা এখনো ভালো করে জানে না যে তিনি পাশ করেননি। তাঁরা জানেন, আগের বছরই তিনি পাশ করে বেরিয়েছেন, এক বছর ধরে চাকরির জন্য ঘুরছেন। সরকারি চাকরি ছাড়া তিনি চাকরি করবেন না বলে সময় নিচ্ছেন। শ্বশুরবাড়ি লালবাগে। শ্বশুরের বড় দোকান আছে কেল্লার কাছে। তিনি অনেক আদরে সেখানে থাকেন। কিন্তু তার একটা আলমারি আছে তিতুমীর হলের এই রুমে। মাঝে মাঝে তিনি রাতেও থাকেন এখানে। সে সময় শ্বশুরবাড়ি থেকে কী বলে যে আসেন আমরা কেউ তা জানি না।

আমি আরো কিছুদিন মেডিকেলের হোস্টেলে থাকি।

সকাল আটটায় ক্লাস। সাতটায় ঘুম থেকে উঠে দুই টাকা পঞ্চাশ পয়সার পরোটা-ভাজি-ডিম-চা’র নাস্তা সেরে  ক্লাসে যাই। বুয়েট ক্যাম্পাসে এই প্রথম ছাত্র হিসাবে যাওয়া। বড় বড় দালান, রাস্তা, হল, সবকিছু নিজের নিজের মনে হতে শুরু করে। আগে ভয়ে ভয়ে তাকাতাম। এখন সেই ভয়টা আর নাই।

আর্কিটেকচার বিল্ডিংটার সৌন্দর্যই আলাদা। প্রশস্থ সিড়ি মাড়িয়ে ৫ তলায় উঠে ক্লাস। ড. মুক্তাদির, যিনি এই ডিপার্টমেন্টের হেডও, তিনি এলেন প্রথম ক্লাসে। কী কী বলেছিলেন আজ আর মনে নাই। তবে আজ যেহেতু সোমবার, তাই টি ব্রেকের পর এগারোটায় নিয়ে যাওয়া হলো ওয়ার্কশপে। উড ওয়ার্কশপ। এটা নাকি একটা সেশনাল ক্লাস। ৫০ নম্বরের। পাশ করলে লাভ নাই, ফেল করলে ফেল। পুরা ইয়ার রিপিট। কী করে করাত দিয়ে কাঠ কাটতে হয় তার তরিকা শেখার পর কতগুলো কাঠের ফালিকে ৬ ইঞ্চি করে কেটে দেওয়া ছিল কাজ।

দেড়টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত লাঞ্চব্রেক। তারপর আবার আড়াই ঘণ্টার সেশনাল ক্লাস। বিষয়ের নাম—গ্রাফিক্স। গ্রাফিক্স ক্লাসে লিস্ট দেওয়া হলো কী কী কাগজ আর কী কী কলম কিনতে হবে। নিউ মার্কেটের কোন কোন দোকানে তা পাওয়া যায়, তারও নাম।

ক্যাম্পাস জুড়ে হৈ হৈ রৈ রৈ। এই দল ওই দলের মিছিল, স্লোগান। সবাই নবীনদের মিছিলে মিছিলে রক্তিম শুভেচ্ছা জানায়। ব্যানার, ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে পুরা অঙ্গন। সাড়ে দশটার টি ব্রেক মিছিলের উচ্ছ্বাসে ভরে ওঠে। দল করা বড় বড় ভাইয়েরা মিষ্টি করে হাসেন, নিজেদের পরিচয় দেন এবং ক্যাফিটেরিয়াতে চা খাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। কেউ কেউ দাওয়াত দেন ডিনার ও টিভির প্রোগ্রাম সেরে সাড়ে দশটায় হল গেস্ট রুমে চা খাওয়ার, পরিচিত হবার।

দ্বিতীয় দিনে বিটকিলে ধরনের একটা অনুষ্ঠান হলো। এর নাম ‘র‌্যাগ’, ফ্যাকাল্টির ভাষায় ‘ধোলাই দিবস’। ধোলাই দিবসের মূল উদ্দেশ্য—নতুন ছাত্র-ছাত্রীর সাথে ফ্যাকাল্টির অন্যসবের পরিচয়। ক্লাউন শ্রেণির একজন নেতা, যিনি অল্প সময়ে আসর জমাতে ওস্তাদ এবং একটানা তিনঘণ্টা খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে রসিয়ে রসিয়ে অনুষ্ঠান চালাতে পারতেন, তেমন একজন হতেন ‘মডারেটর’। আমরা প্রথম বছর পেয়েছিলাম মঞ্জুর ভাইকে। পরের বছর যদিও তার বিদায় ছিল। তবুও তাঁকেই  আবার ডাকা হয়েছিল ধোলাই পর্ব পরিচালনায়। এর পরের বছরগুলোতে মামুন ভাই, মাহবুব ভাই এবং আমাদের সাথের রম্যও এ কাজটি ভালোভাবে চালিয়ে যেতে পেরেছিল।

সাদামাটা তিন চারঘণ্টার এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের পূর্ব-শর্ত ছিল নিজের জুতা-স্যান্ডেল ক্লাসরুমে রেখে, নিজের টুলটি মাথায় করে বড় একটা ক্লাস রুমে নিয়ে যাওয়া। সিনিয়রদের খবরদারি সেখান থেকেই শুরু হয়ে যেত। যে ছাত্রীটি কখনো গ্লাসে পানি ঢেলেও খায়নি, তাকেও যে কোনো মূল্যে নিজের টুল মাথায় করে নিয়ে যেতে হতো। অনুষ্ঠান শেষে নিজের স্যান্ডেল-জুতা না পাওয়া ছিল নিয়মেরই অংশ। তবে হারাত না কিছুই, খুঁজতে সময় লাগত বেশ।

ক্লাসরুমের সামনের অংশে আধা নোংরা ফ্লোরের ওপর পা মেলে বসে থাকার পর রোল নম্বর অনুযায়ী ডেকে ডেকে দাঁড় করানো হতো একেকজনকে। নিজের নাম, কলেজের নাম আর কারো কারো দেশের বাড়ি বলার পর, যার কপাল খুব ভালো, সে হয়তো এক-আধ লাইন গান গেয়ে পার পেয়ে যেত। তবে থলের ভিতর তাবিজবৎ কাগজের মধ্যে যা কিছু লেখা থাকত তা না করা পর্যন্ত নিস্তার ছিল না। বড় ভাইয়েরা বরাবরই ছেলেদের প্রতি ছিলেন উদার এবং অনীহাগ্রস্ত। আমাদের মধ্যে যেসব মেয়ে ছিল এবং বিশেষ করে, যাদের গায়ের রং ছিল কিছুটা দেখার মতো—তাদের নিস্তার ছিল না। যে কোনো মূল্যে বাংলা সিনেমার একটা সংলাপ, যা কাগজের মধ্যে লেখাই থাকত, তা তাকে অভিনয় করে দেখাতে হতো। এক্ষেত্রে শব্দসমূহ উচ্চারণ করতেও যদি কোনো ছাত্রীর আপত্তি কান্নার রোলে বিবর্তিত হতো, তাও রক্ষা ছিল না।

আমাদের তনুর ভাগে পড়ল এক সিনেমার ডায়লগ। তাকে বলতে হবে, ‘শয়তান, তুই আমার দেহ পাবি তো মন পাবি না’। তনু এই কাগজটি হাতে নিয়ে কান্না শুরু করে দিলো। কিন্তু কান্নাকাটি কোনো সমাধান নয়। বড় ভাই শুনতে পেয়েছেন, এমন স্বরে হলেও তাকে এই সংলাপ বলে পার পেতে হয়েছিল।

আমার পালা এলে পড়লাম আরো বিপদে। মনজুর ভাই বলেন—‘ও ক্যাডু? তুই এইচ, না পি’?

আমি ‘এইচ’ বা ‘পি’র কিছুই বুঝি না। কিন্তু জবাব আমাকে দিতেই হবে। একবার বলি ‘এইচ,। সবাই মিলে হাসে। আবার বলি ‘পি’। আরো জোরে সবাই হাসে। এবার বলা হলো—ফ্রন্ট রোল দাও। আমি পটাশ করে দুইটা ডিগবাজি খেয়ে বিদায় নিলাম।

র‌্যাগ শেষে বড় ভাইয়েরা গল্পের উপদেশ বাণীর মতো র‌্যাগের উপকারিতার ভাষণ দিলেন। বলেন—‘ফ্যাকাল্টির ৫ বছরের কত টিচার কতভাবে পঁচাবার চেষ্টা করবে। সারারাত জেগে ডিজাইন করে সকালে টিচারকে দেখানো মাত্র তোমার ডিজাইন উড়িয়ে দেবে। তখন যাতে অপমানবোধ না জাগে তার জন্য এসব। নিজের মধ্যে রেজিস্ট্যান্স তৈরি করার জন্য এর কোনো বিকল্প নাই।’ বড় ভাইদের এসব উপদেশবাণী কর্ণমূলে নিয়ে, বড়ই বেদনাহত হয়ে ধোলাই দিবসে দুটো ফ্রন্টরোল দিয়ে ডিপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে যাই।

আমি দিনে ক্লাস করি বুয়েটে, রাতে গিয়ে মেডিকেল হোস্টেলে ঘুমাই। আমার একটা কালো রঙের ব্যাগ আছে। এই ব্যাগের ভেতর থাকে আমার ড্রাফটিং পেন্সিল, সেট স্কোয়ার। আর থাকে কিছুদিন আগে পাওয়া একটা ইয়াসিকা এম এফ টু অটোফোকাস ক্যামেরা।

এরমধ্যে আমি নাট্যকার হয়ে গেছি আর কয়েকটা পত্রিকায় আমার লেখা বেরিয়ে গেছে, এটুকু জেনে মেডিকেলের অন্য ছাত্ররা আমাকে প্যারাসাইট মনে করে অত তাচ্ছিল্য করে না। ৮ নাম্বার রুমে আবুল হাসনাত মিল্টন নামে কৃষ্ণকায় এক ছেলের সাথে পরিচয় হয়। সেও ঝিনাইদহের ক্যাডেট। তৌকীরের সাথে ছিল। কবিতা লেখে, আবৃত্তি করে। আমারে বেশ পাত্তা দেয়। তাদের কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান হলে আমাকে নিয়ে যায়।

একদিন তৌকীরের অনুরোধে শহীদ মিনারে গেলাম। তাদের একটা পথনাটক আছে—থিয়েটারের পালাবদল। ওয়ার্কশপে যারা চান্স পেয়েছিল তারাই অভিনয় করবে। এই প্রথম আমার পথনাটক দেখা। তৌকীরকে দেখলাম লাঠি নিয়ে কী কী করল। দূরে ছিলাম, কথা বুঝিনি।

সেদিনই  অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন বাতিলের লক্ষ্যে ৬ দিনের পথনাট্য উৎসবের সূচনা হলো। ফেরদৌসী মজুমদারের উপস্থাপনায় বক্তৃতা করলেন বিচারপতি কামাল উদ্দিন হোসেন, রামেন্দু মজুমদার, মামুনুর রশীদ, সন্তোষ গুপ্ত আর লিয়াকত আলী লাকি।

মিল্টনের  সাথে বিকেলবেলা টিএসসিতে চলে আসি। আমার সাথে আলাউদ্দিনও থাকে। তার খুব শখ আবৃত্তি শিখবে। কামরুল হাসান মঞ্জুর একটা কোর্স আছে। সেখানে সে ভর্তি হয়েছে। আমি তাকে টিএসসিতে ঢুকিয়ে বাইরে হাঁটাহাঁটি করি। টিএসসির সামনে একটা সড়ক দ্বীপ আছে। এখানে প্রতিদিন বিকালবেলা নাটক, গান, কবিতা আবৃত্তি হয়। অনেক দল, অনেক লোক, কিন্তু বিষয় একটা—এরশাদ। প্রায় নাটকেই হাসপ্যান্ট পরা কিছু ঠোলা থাকে। এগুলো সবাই সেনা বাহিনী। লিয়াকত আলী লাকি, রেজানুর রহমান, লিমন, এরা বেশ ভালো জমাতে পারেন।

ফেব্রুয়ারি মাসের ১৫ তারিখ থেকে বইমেলা শুরু হলো। আমি ক্যামেরা নিয়ে হাজির। এই আমার প্রথম ঢাকার বইমেলা দেখা। আমি লেখক দেখতে পছন্দ করি। বড় লেখকদের সবাইকে আমি চিনি। আমাকে এক হুমায়ূন আহমেদ ছাড়া আর কেউ চেনেন না। মেলায় দেখি এক স্টলে হুমায়ূন আহমেদ বসে বসে তার বইয়ে অটোগ্রাফ দিচ্ছেন। সামনে অনেকগুলো তরুণী। এরা সম্ভবত নার্স বা মেডিকেল স্টুডেন্ট। আমি দূরে থেকে তার ছবি তুলি। আরেক লেখকের কাছেও ভিড়। তিনি অনেক তরুণ, নাম ইমদাদুল হক মিলন। আমি বলি, আপনার একটা ছবি তুলি? মিলন পরেছেন জিন্সের প্যান্ট, পায়ে ক্যাডস, সাথে টি শার্ট। বলতেই তিনি চারিদিক নামক এক স্টলের সামনে দুই পা আড়াআড়ি করে বুকের কাছে হাত দুটো ভাঁজ করে, মাথা বাকিয়ে দাঁড়িয়ে যান। আমি দূর থেকে একটা তুলি, মুখের কাছে ক্যামেরা নিয়ে আরেকটা (পরের ছবিটা নিকটদূরত্বের কারণে ঘোলা হয়ে যায়)।

বর্ধমান হাউজে দেখি এক লোক বড় বড় লেখকদের চমৎকার পোর্টেটের এক্সিবিশন করছে। ছবির পাশে লেখকদের অটোগ্রাফও। ফটোগ্রাফারের নাম নাসির আলী মামুন। ছবিগুলো কেমন যেন। বেশিরভাগ অংশ কালো, ছায়া ভরা। অল্প অংশ সাদা। কিন্তু কী ব্যাঞ্জনাময়। আমার ইচ্ছা করে এ রকম ছবি তুলতে। কিন্তু এই অটোফোকাস ক্যামেরা দিয়ে ক্যামনে এ রকম ছবি তুলতে হয় আমি জানি না।

কিস্তি ৩. বুয়েটপরশ

   

মহাশূন্যে যাবে জাপানের তৈরি কাঠের স্যাটেলাইট



বিজ্ঞান ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

মহাশূন্যে উৎক্ষেপণের জন্য কাঠের স্যাটেলাইট তৈরি করেছেন জাপানের বিজ্ঞানীরা। এটি স্পেসএক্স থেকে মহাশূন্যে উৎক্ষেপণ করা হবে বলে জানিয়েছেন তারা।

বুধবার (২৯ মে) ইয়েমেনের বার্তাসংস্থা সাবা এ বিষয়ে একটি খবর প্রকাশ করেছে।

খবরে জানানো হয়, জাপানের কিয়েটো বিশ্ববিদ্যালয় ও সুমিটোমো ফরেস্ট্রি ফাউন্ডেশন বিশেষজ্ঞেরা ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত চার বছরের চেষ্টায় এই স্যাটেলাটটি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন।

বুধবার কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, বিজ্ঞানীরা ৪ বছরের কঠোর পরিশ্রম করে কাঠের তৈরি স্যাটেলাইটটি তৈরি করেছেন। এই স্যাটেলাইটের নামকরণ করা হয়েছে, ‘লিগনোস্যাট’ (LignoSat)। এটি পৃথিবীর সর্বপ্রথম কাঠের তৈরি স্যাটেলাইট। পরিবেশের কথা চিন্তা করে এই স্যাটেলাইটটি তৈরি করা হয়েছে। এটি যখন তার অভিযান শেষ করে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করবে, তখন এটি সম্পূর্ণভাবে পুড়ে যাবে।

বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ‘লিগনোস্যাট’ স্যাটেলাইটির আকৃতি ১০ সেন্টিমিটার। এটির পুরুত্ব ৪ থেকে ৫.৫ মিলিমিটার। তবে এটির ভেতরের স্তর হবে অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে তৈরি এবং এর ভেতরে একটি সোলার প্যানেল থাকবে। সবমিলিয়ে এটার ওজন হবে মাত্র এক কেজি। এই স্যাটেলাইট সম্পূর্ণ সনাতনী জাপানি পদ্ধতিতে কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। এতে কোনো ধরনের ‘অ্যাডহেসিভ’ (আঠা) ব্যবহার করা হয়নি।

জাপানি বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, ‘লিগনোস্যাট’ স্যাটেলাইটটি স্পেসএক্স থেকে এ বছরই উৎক্ষেপণ করা হবে। তারা আরো জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে এটি পৃথিবীর বাইরে পরীক্ষামূলকভাবে উড়াল সম্প্ন্ন করেছে। স্যাটেলাইটটি কী কাজে ব্যবহার করা হবে, তা অবশ্য জানানো হয়নি।

;

১২৫তম জন্মবর্ষ

মুক্তির অন্বেষী নজরুল



ড. মাহফুজ পারভেজ
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

নজরুল জীবনের ‘আর্তি ও বেদনা’র সম্যক পরিচয় পেতে হলে সেকালের মুসলিম সমাজের সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের কিছু আলোচনা আবশ্যক হয়ে পড়ে। নজরুলের আবির্ভাবকালে মুসলমানদের সামাজিক আবহাওয়া এমনই জীর্ণ ও গণ্ডিবদ্ধ ছিল যে, কোনো শিল্পীরই সেই আবহাওয়াতে আত্মবিকাশ ও আত্মপ্রসার সম্ভব ছিল না। জীবনের প্রথমদিকে তাই কামাল পাশা প্রমুখ ইতিহাসখ্যাত বীর মুসলিমেরা নজরুল-মানসকে আচ্ছন্ন করেছিল।

কিন্তু অচিরেই তিনি বাঙালির জাগরণের পথিকৃতে রূপান্তরিত হন। বাংলার জাগরণ গ্রন্থে ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’-এর অগ্রণীজন কাজী আবদুল ওদুদ জানাচ্ছেন, ‘নজরুলের অভ্যুদয়ের পরে ঢাকায় একটি সাহিত্যিক গোষ্ঠীর অভ্যুদয় হয়; তাঁদের মন্ত্র ছিল ‘বুদ্ধির মুক্তি’ এবং যারা ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করে বুদ্ধির মুক্তি ঘটাতে চেয়েছিলেন এবং বাঙালি মুসলমানের চেতনার জগতে নাড়া দিলে সচেষ্ট হয়েছিলেন।’

চরম দারিদ্র্যের মাঝে থেকেও জীবনের জয়গান গেয়েছেন কবি নজরুল, ছবি- সংগৃহীত

উল্লেখ্য, ১৯ জানুয়ারি ১৯২৬ সালে ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় অধ্যাপক ও ছাত্রের মিলিত প্রয়াসে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ নামে একটি সংগঠনের জন্ম হয়। সংগঠনটির সঙ্গে ‘সাহিত্য’ শব্দটি যুক্ত থাকলেও এটি গতানুগতিক ও মামুলি কোনো সাহিত্য সংগঠন ছিল না। ‘সাহিত্য’ শব্দটিকে বৃহত্তর পরিসর ও অর্থে গ্রহণ করেছিলেন উদ্যোক্তারা। ফলে, তাঁদের কাছে সাহিত্যচর্চা ছিল জীবনচর্চার নামান্তর। এই সংগঠনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মুক্তবুদ্ধির চর্চা করা। নিজেদের কর্মকাণ্ডকে তাঁরা অভিহিত করেছিলেন ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ নামে।

‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-প্রতিষ্ঠার পরের বছরেই (১৯২৭) সংগঠনের বার্ষিক মুখপত্র হিসেবে সাময়িকী ‘শিখা’ প্রকাশ করে, যে কারণে এদের ‘শিখা গোষ্ঠী‘ নামেও অভিহিত করা হয়।

শিখা প্রকাশিত হয়েছিল পাঁচ বছর (১৯২৭-১৯৩১)। বাঙালি মুসলমানের বিভিন্ন সমস্যা তথা শিক্ষা, সাহিত্য, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, দর্শন, চিন্তা ইত্যাদি নিয়ে জ্ঞানদীপ্ত আলোচনা করেছেন এই সমাজের লেখকগণ। ‘বুদ্ধির মুক্তি ও কবি নজরুলকে মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

বুদ্ধির মুক্তি, মানব মুক্তি, সমাজের মুক্তি তথা মানুষের শির উচ্চতর করার বাণী উৎকীর্ণ করেছিলেন নজরুল। গেয়েছিলেন মানবতার জয়গান। অসাম্প্রদায়িকতা ও সাম্যের গানে মুখরিত ছিল তাঁর জীবন ও কর্ম। মানুষের চেয়ে বড় কিছু ছিল না তাঁর কাছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে চির বিদ্রোহী ছিলেন তিনি। জগতের বঞ্চিত, ভাগ্য বিড়ম্বিত, স্বাধীনতাহীন বন্দিদের জাগ্রত করার মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন নজরুল। মানবতার জয়গান গেয়ে লিখেছিলেন-'গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান্ …’।

মানুষ আর মানুষের হৃদয়কে সবকিছুর ঊর্ধ্বে রেখে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন- ‘এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই’। আবার তাঁর কলম থেকেই বেরিয়ে এসেছিল বজ্রনির্ঘোষ আহ্বান- ‘জাগো অনশন-বন্দি, ওঠ রে যত জগতের বঞ্চিত ভাগ্যহত’।

শুধু যে কবিতাই লিখেছেন তা তো নয়। তিনি এমন অনেক প্রবন্ধও রচনা করেছেন। নজরুলের দেশপ্রীতি, দেশের মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা আজও অনুপ্রাণিত করে। তিনি ছিলেন জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে।

সাম্য ও মানুষের কবি ছিলেন কবি নজরুল ইসলাম, ছবি- সংগৃহীত

‘সাম্য, সম্প্রীতির কবি নজরুল তাঁর হৃদয়মাধুর্য দিয়ে সব শ্রেণিবৈম্য দূর করতে চেয়েছিলেন। তাঁর কাছে জাত–ধর্ম ছিল হৃদয়ের প্রেমধর্ম; যে প্রেম মানুষের কল্যাণে উৎসারিত হয়ে ওঠে। শুধু লেখনীর দ্বারা নয়, নিজের জীবনের সবরকম ঝুঁকি নিয়ে ঐক্যের আশায় আশাবাদী ছিলেন নজরুল।

তাঁর ব্যক্তিজীবনে এই ভাবনার প্রয়োগ করেছিলেন তাঁর বিবাহের ক্ষেত্রে, পুত্রদের ক্ষেত্রেও। তাঁর পরিবারের সব সদস্য এবং আপামর বাঙালি এই সত্য নিত্য উপলব্ধি করেন।

১২৫তম জন্মবর্ষে বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের চৈতন্য মুক্তির অন্বেষী। তাঁর গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক তথা সুবিশাল সাহিত্যকর্ম বর্তমান পরিস্থিতিতে শুধু প্রাসঙ্গিকই নয়, নানা কারণে তাৎপর্যবাহী।

কেননা, বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রখর প্রতাপে ত্রস্ত এবং যুদ্ধ ও আগ্রাসনে জর্জরিত পৃথিবীতে থেমে নেই অন্যায়, অবিচার, হামলা, নির্যাতন।

ইউক্রেন, ফিলিস্তিন থেকে মিয়ানমার হয়ে দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত পৃথিবীময় শোষণ, নির্যাতন, হত্যা, রক্তপাতে ক্ষত-বিক্ষত-রক্তাক্ত করোনা-বিপর্যস্ত পৃথিবী আর মানুষ এখন অবর্ণনীয় দুর্দশা ও দুর্বিপাকে বিপন্ন।

এমতাবস্থায় অনাচারের বিরুদ্ধে চিরবিদ্রোহী নজরুলের মানব অধিকারের রণহুঙ্কার বড়ই প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয়। কারণ, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মহীরুহ-তুল্য কাজী নজরুল ইসলাম প্রেম, বিদ্রোহ, মুক্তি ও মানবতার মহান সাধক।

১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ অবিভক্ত বৃটিশ-বাংলার সর্বপশ্চিম প্রান্তের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়ায় জন্ম নেন কাজী নজরুল ইসলাম আর ১৩৮৩ বঙ্গাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (সাবেক পিজি হাসপাতাল) শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

বাংলাদেশের এবং বিশ্বব্যাপী বাংলাভাষীদের শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায় কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়, যেমনটি তিনি নিজেই বলেছিলেন, ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই।'

উল্লেখ্য, কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুর পর তাঁর কবরস্থানের স্থান নির্ধারণ নিয়ে নানাজন নানামত দিতে থাকেন। এ অবস্থায় স্থাননির্ধারণী সভায় রফিকুল ইসলাম প্রস্তাব করেন নজরুল তাঁর এক গনে লিখেছেন-

‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই/ যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই’॥

সুতরাং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণে তাঁর কবর হোক। তাঁর এ প্রস্তাব সভায় গৃহীত হলো। পরবর্তীকালে এ কবর পাকা ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করার ক্ষেত্রেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবি নজরুলকে ভারত থেকে ঢাকায় নিয়ে আসেন, ছবি- সংগৃহীত

‘বিদ্রোহী কবি’ কাজী নজরুল ইসলামের গান ও কবিতা যুগে যুগে বাঙালির জীবনযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণার উৎস হয়ে কাজ করেছে। তাঁর বিখ্যাত কবিতাগুলির একটি 'বিদ্রোহী', যা স্পর্শ করেছে রচনার শতবর্ষের ঐতিহাসিক মাইলফলক।

কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়, ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি ‘বিজলী’ পত্রিকায়। এরপর কবিতাটি মাসিক ‘প্রবাসী (মাঘ ১৩২৮), মাসিক ‘সাধনা (বৈশাখ ১৩২৯) ও ‘ধূমকেতু’তে (২২ আগস্ট, ১৯২২) ছাপা হয়।

বলা বাহুল্য, অসম্ভব পাঠকপ্রিয়তার কারণেই কবিতাটিকে বিভিন্ন পত্রিকা বিভিন্ন সময়ে উপস্থাপিত করেছিল। ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশিত হওয়া মাত্রই ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি করে। দৃপ্ত বিদ্রোহী মানসিকতা এবং অসাধারণ শব্দবিন্যাস ও ছন্দের জন্য আজও বাঙালি মানসে কবিতাটি ও রচয়িতা কবি নজরুল ‘চির উন্নত শির’ রূপে বিরাজমান।

পুরো বাংলা ভাষা বলয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে এমন শাণিত প্রতিবাদ তুলনাহীন। বিদ্রোহীর শতবর্ষকে ‘জাগরণের শতবর্ষ’ রূপে উদযাপন করা হয়, বাংলা ভাষাভাষী পরিমণ্ডলে আর ১২৫তম জন্মবর্ষে মুক্তির অন্বেষী নজরুলকে শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় স্মরণ করে সমগ্র বাঙালি জাতি!

 ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম

;

শ্রীপুরের কাওরাইদে নজরুল উৎসব শনিবার



ডেস্ক রিপোর্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কাওরাইদ কালি নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ‘ভাগ হয়নিকো নজরুল’ শীর্ষক নজরুল উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে শনিবার। ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের আয়োজনে এবং নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর সহযোগিতায় এই উৎসবে সেমিনার, আবৃত্তি ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জাতীয় কবির বর্ণাঢ্য জীবন ও সাহিত্যকে তুলে ধরা হবে।

নেতাজী সুভাষ-কাজী নজরুল স্যোশাল অ্যান্ড কালচারাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এর অন্যতম ট্রাস্টি আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক জানান, আয়োজনের শুরুতে শনিবার দুপুর ২টায় সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সুনীল কান্তি দে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক ড. সাইম রানা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস ও ছায়ানট (কলকাতা)’র সভাপতি সোমঋতা মল্লিক।

তিনি আরও জানান, বিকেলে আয়োজনে নজরুলের জাগরণী কবিতা ও গান পরিবেশন করবেন দেশের বরেণ্য শিল্পীরা। আবৃত্তি করবেন-টিটো মুন্সী ও সীমা ইসলাম। নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করবেন শিল্পী ফেরদৌস আরা, সালাউদ্দিন আহমেদসহ অনেকে। সমাপনী পর্বে প্রধান অতিথি থাকবেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ইমেরিটাস অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে সমাপনী অনুষ্ঠানে থাকবেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার।

‘দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে নজরুল চর্চা বেগবান করতে এই উৎসব আয়োজন করা হয়েছে। এবছর কবি নজরুলের ১২৫তম জন্মবর্ষ। এই বছরটি নজরুলচর্চার জন্য খুবই সবিশেষ। উৎসবে দুই দেশের বিশিষ্ট লেখক ও গবেষকদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে সাময়িকী। সাম্য, মানবতা ও জাগরণের যে বাণী কবি সৃষ্টি করে গেছেন, সমকালীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজের জন্য তা আলোকবর্তিকা। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নজরুলের এই আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে দিতেই আমাদের এই প্রচেষ্টা’-বলেন আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী বীরপ্রতীক। 

;

শিশু নজরুল



এ এফ এম হায়াতুল্লাহ
কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী থেকে সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারত। এটি বাংলাদেশের তুলনায় আয়তনের দিক দিয়ে বহুগুণ বড় একটি দেশ। বহুজাতির বহু মানুষের বাস সে দেশে। ঐ দেশ অনেকগুলো প্রদেশে বিভক্ত। এই প্রদেশগুলোকে বাংলা ভাষায় রাজ্য বলে অভিহিত করা হয়। এই ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত তদানীন্তন বাংলা প্রদেশের পূর্বাঞ্চল আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আর পশ্চিমাঞ্চল ‘পশ্চিম বঙ্গ’ নামে ভারতের অন্তর্গত রয়ে গেছে।

এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার অধীন আসানসোল মহকুমার অন্তর্গত জামুরিয়া থানার অন্তর্ভুক্ত চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে এবং ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ তারিখে জন্মলাভের পর একটি শিশুর কাজী নজরুল ইসলাম নাম রাখেন যে পিতা তার নাম কাজী ফকির আহমদ। আর যে মায়ের কোলে তিনি জন্মান তার নাম জাহেদা খাতুন। এই শিশুটির জন্মের আগে এই পিতামাতার আর-ও ৪ জন সন্তান জন্মের সময়ই মারা গিয়েছিল। শুধু তাদের প্রথম সন্তান কাজী সাহেবজানের বয়স তখন ১০ বছর। অর্থাৎ কাজী নজরুলের সর্বজ্যেষ্ঠ বড় ভাই শিশু কাজী নজরুলের চাইতে ১০ বছরের বড় ছিলেন। নজরুলের পর তার আর-ও একজন ভাই ও বোনের জন্ম হয়েছিল। ভাইটির নাম ছিল কাজী আলী হোসেন এবং বোনটির নাম ছিল উম্মে কুলসুম।

শিশু নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমদ বই-পুস্তক পড়তে পারতেন। তিনি স্থানীয় মসজিদ ও মাজারের সেবা করতেন। রাজ্য শাসকগণ কর্তৃক বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ অর্থাৎ বিচারকগণ উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতেন। মুসলমান সমাজ থেকে বিচারকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাজী বলা হত। মুসলমান সমাজে কাজীগণ অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হতেন। নজরুল ইসলাম এইরূপ সম্মানিত পরিবারে জন্মপ্রাপ্ত এক শিশু। তাই জন্মের পর ক্রমশ বেড়ে উঠার পর্যায়ে তিনি পারিবারিকসূত্রেই ভাল-মন্দের পার্থক্য করার এবং হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত হয়ে সকলকে সমভাবে ভালবাসার গুণাবলি অর্জন করেন।

মানবজাতির ইতিহাসে যে-সমস্ত মহাপুরুষ বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের অধিকাংশই শৈশব থেকে নানারূপ দুঃখ-কষ্টে পতিত হয়ে সেগুলো জয় করে মহত্ত্ব অর্জন করেছেন। তাদের কেউই একদিনে বড় হয়ে যাননি কিংবা বেড়ে-ও উঠেন নি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত মুহাম্মদ (সঃ) জন্মানোর আগেই পিতাকে হারিয়েছিলেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে হারিয়েছিলেন জন্মদাত্রী মাকেও। নজরুল তার পিতাকে হারান নয় বছর বয়সে ১৯০৮ সালে। পিতা তাকে গ্রামের মক্তবে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছিলেন। তখনকার দিনে পড়াশোনা করার জন্যে সরকারি ব্যবস্থা ছিলনা। বাংলাদেশের তখন জন্ম হয়নি।

বিশেষ ভঙ্গিমায় হাবিলদার নজরুল

নজরুলের জন্মভূমি বাংলা প্রদেশ ভারতবর্ষের একটি রাজ্য যা ছিল বিদেশী ব্রিটিশ শাসনাধীন তথা পরাধীন। ব্রিটিশ শাসকরা এদেশের সাধারণ মানুষ তথা প্রজাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেনি। কারণ শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ সচেতন হয়ে উঠে-তাদের আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয়-তারা পরাধীন থাকতে চায় না-স্বাধীনতার প্রত্যাশী হয়। বিদেশী শাসক ব্রিটিশরা সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষা উন্মুক্ত না করায় জনসাধারণ সম্মিলিতভাবে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করত। সেই প্রতিষ্ঠানে প্রধানত মাতৃভাষা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হত। এইসব প্রতিষ্ঠান মক্তব নামে পরিচিত হত। এগুলো পরিচালনার ব্যয় অর্থাৎ শিক্ষকদের বেতন মক্তব প্রতিষ্ঠারাই দান, সাহায্য ও অনুদান সংগ্রহ করার মাধ্যমে নির্বাহ করতেন। গ্রামীণ একটি মক্তবে নজরুলের পাঠগ্রহণ শুরু। তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর।

একবার কিছু শোনে ও দেখেই তিনি তা মনে রাখতে পারতেন। কিন্তু শিশুসুলভ সকল প্রকার চঞ্চলতা-ও তাঁর ছিল। পিতৃবিয়োগের পর সেই চঞ্চলতার যেন ছেদ পড়ল। তার মেধাগুণে তিনি হয়ে উঠলেন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে সেই মক্তবেরই শিক্ষক। একজন শিশু শিক্ষক। এক শিশু পড়াতে লাগলেন অন্য শিশুকে। উদ্দেশ্য নিজের অর্জিত জ্ঞান ও বিদ্যা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। নিজেকে অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া। কিছু দেয়ার মাধ্যমে আনন্দ লাভ-যে আনন্দ মহৎ।

তার ভেতরে ছিল এক ভবঘুরে মন। মক্তব ছেড়ে ভর্তি হলেন উচ্চ বিদ্যালয়ে-মাথরুন নবীন চন্দ্র ইনস্টিটিউশনে। স্থিত হলেন না সেখানে। গ্রামীণ নিসর্গ, প্রকৃতি, ঋতুচক্র যেমন তার মনকে প্রভাবিত করে, অজানাকে জানার এবং অচেনাকে চেনার নিরন্তর কৌতূহল-ও তাকে আন্দোলিত করে। ঘরছাড়া স্বভাবের এই শিশু অন্য সকল মানুষের জীবন ও সংগ্রামের রহস্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ঘর তাকে বাঁধতে পারে না। বিশাল আকাশকেই তার মনে হয় তার মাথার ওপরে খাঁচার মত উপুড় হয়ে তাকে আটকে রেখেছে। তাই তিনি মনে মনে ‘ভূলোক, গোলোক ও দ্যুলোক’ ছাড়াতে চাইতেন কেবলÑনিজেকে মুক্ত করতে চাইতেন। মনের আহ্বানে সাড়া দিতেন, গান শোনাতেন, শুনে শুনে গাইতেন।

তারই পরিক্রমায় গ্রামীণ লোক-নাট্য ‘লেটো’ গানের দলে যোগ দিলেন। সেখানেও তার দলপতি উস্তাদ শেখ চকোর গোদা ও বাসুদেব তাকে সেরাদের ‘সেরা’ বলে স্বীকৃতি দিলেন। তিনি শুধু লেটোর দলে গানই গাইলেন না। গানের পালা রচনা করলেন। ‘ মেঘনাদ বধ’, ‘হাতেম তাই’ ‘চাষার সঙ’, ‘আকবর বাদশা’ প্রভৃতি পালা রচনা করতে যেয়ে হিন্দু পুরাণ রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, বেদ যেমন পড়লেন, তেমনি পড়লেন কোরান-হাদিস, ইতিহাস-কাব্য প্রভৃতি। মক্তব-বিদ্যালয় ছেড়ে হয়ে গেলেন প্রকৃতির ছাত্র।

কিন্তু আগুন যে ছাই চাপা থাকে না। প্রতিভার আগুনের শিখা দেখে ফেললেন পুলিশের এক দারোগা, যিনি নিজেও কাজী বংশের সন্তান, রফিজুল্লাহ। চাকরি করেন আসানসোলে। কিন্তু তার জন্মস্থান ময়মনসিংহ জেলা। নি:সন্তান রফিজুল্লাহ মায়ায় পড়ে গেলেন শিশু নজরুলের। নিয়ে এলেন জন্মস্থান ময়মনসিংহে। ভ্রাতুষ্পুত্রের সাথে ভর্তি করে দিলেন দরিরামপুর হাই স্কুলে। কেমন ছিলেন তিনি এখানে ? জন্মভিটা চুরুলিয়া থেকে কয়েকশত কিলোমিটার দূরে-মাতৃআঁচল ছিন্ন পিতৃহীন শিশু! সহপাঠীরা কেউ লিখে রাখেন নি।

১৯১১ সনে ময়মনসিংহে আনীত হয়ে থাকলে পেরিয়ে গেছে একশত তের বছর। সহপাঠীদের কেউ বেঁচেও নেই। কিন্তু বেঁচে আছে নানারূপ গল্প ও কল্পনা। বড় বড় মানুষদের নিয়ে এমনই হয়। তাদেরকে কেন্দ্র করে অনেক কাহিনী তৈরী করা হয়। মানুষ জীবনের গল্প শুনতে ভালবাসে। তাই জীবন নিয়ে গল্প তৈরী হয় কিন্তু তা জীবনের অংশ না-ও হতে পারে। কেউ বলেন নজরুল ময়মনসিংহের ত্রিশালে এক বছর ছিলেন, কেউ বলেন দেড় বছর, কেউবা দু’বছর। প্রথমে ছিলেন কাজী রফিজুল্লাহ’র বাড়ি। এরপরে ছিলেন ত্রিশালের নামাপাড়ায় বিচুতিয়া বেপারির বাড়ি। এই দু’বাড়িতে থাকা নিয়ে অবশ্য কোন বিতর্ক নেই। কিন্তু তর্ক আছে তার প্রস্থান নিয়ে।

কেউ বলেন তিনি স্কুল-শিক্ষকের কাছে সুবিচার না পেয়ে, কেউ বলেন অভিমান করে চলে গিয়েছিলেন। তবে তিনি কাউকে না বলেই চলে গিয়েছিলেন এটাই প্রতিষ্ঠিত মত। কিন্তু গেলেন কোথায় ? সেই জন্মস্থানে। তবে এবার চুরুলিয়া থেকে বেশ দূরে রাণীগঞ্জের শিহাড়সোল সরকারি স্কুলে সরকারি বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হলেন অষ্টম শ্রেণিতে। ১৯১৫ সন। পড়াশোনা করলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। দশম শ্রেণি পর্যন্ত একটানা। নজরুলের চঞ্চলমতি, ঘরছাড়া ও ভবঘুরে স্বভাবের জন্যে যেন বেমানান। প্রতিটি ক্লাসে প্রথম হলেন।

মেধাবী বলেই নিয়মিত মাসিক ৭ টাকা বৃত্তি পেতেন। ঐ সময়ের হিসাবে মাসিক ৭ টাকা অনেক টাকা। মাসিক ৩ থেকে ৪ টাকায় সকল প্রকার থাকা-খাওয়ার ব্যয় মিটিয়ে অনায়সে চলা যেত। দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে এন্ট্রান্স বা মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার কথা। সে প্রস্তুতি চলছে। নিচ্ছেন-ও। হঠাৎ ব্রিটিশ শাসকদল কর্তৃক যুদ্ধযাত্রার ডাক। কিন্তু প্রলোভন দেখানো হলো যে ব্রিটিশরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জিততে পারলে ভারতবর্ষকে মুক্ত করে দিয়ে যাবে। জন্মাবধি স্বাধীনতা ও মুক্তি-প্রত্যাশীর হৃদয়ে নাড়া দিল। তিনি সাড়া দেবেন কিনা দোদুল্যমান। কিন্তু কপট ব্রিটিশ জাতি বাঙালিকে উত্তোজিত করার নিমিত্ত অপবাদ ছড়ালো যে বাঙালিরা ভীরু।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকার কবিভবনে নজরুল

তারা লড়তে, সংগ্রাম করতে, যুদ্ধে যেতে ভয় পায়। স্বল্পকাল পরের (১৯১৭ সালের মাত্র চার বছর পর লিখিত হয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ১৯২১ সনে) বিদ্রোহী কবির রক্ত ক্ষোভে নেচে উঠলো। কে রুখে তার মুক্তির আকাক্সক্ষা! বাঙালি সেনাদের নিয়ে গঠিত ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে নাম লিখিয়ে বাস্তব যুদ্ধযাত্রা করলেন। গন্তব্য করাচি। ১৯১৭-১৯১৯ সাল অব্দি কঠোর সৈনিক জীবন। সুকঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যেই সাধারণ সৈনিক থেকে হাবিলদার পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পাশাপাশি আরবি-ফার্সি সাহিত্যে অধ্যয়নসহ সঙ্গীতে ব্যুৎপত্তি অর্জনের জন্য মহাকালের এক অবিস্মরণীয় কবি-শিল্পী হিসেবে নিজেকে নির্মাণের ক্ষেত্রে করাচির জীবনই ছিল এক সাজঘর। যুদ্ধযাত্রার পূর্ব পর্যন্ত নজরুল শিশু। কিন্তু যুদ্ধফেরত নজরুল এক পরিপূর্ণ তরুণ ও চিরকালীন শিল্পী-যার মন ও মানস শিশুর মত আজীবন নিষ্পাপ।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট 

;